ধ্রুবর বিবেক –  খারাপ হবার প্রথম দীক্ষা !

মেডিকেল মোড় রংপুর।  সারা দিনের প্রচন্ড ক্লান্তি আর অবসাদ নিয়ে ধ্রুব  দাঁড়িয়ে ছিল।অপেক্ষা করছিল বাড়ি ফিরবে। ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। 

দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এক রিক্সাওয়ালা আর তার বৃষ্টির বিরুদ্ধে যুদ্ধ দেখছে ধ্রুব। চৈত্র মাস। হঠাৎ বৃষ্টি আসবে কেউ ভাবতে পারেনি। তাই প্রস্তুতিও নেই কারো। বেচারা বহু কষ্টে রিকশার মধ্যে হাত-পা গুটিয়ে পাতলা রেকসিন জড়িয়ে বসে আছে। 

ধ্রুব খেয়াল করল একটা লাল কি যেন, অনেকটা জোনাকির আলোর মত, জ্বলছে। মনে মনে হাসলো ধ্রুব। সিগারেটের ধোঁয়ায় উষ্ণতা পাবার চেষ্টা। ধ্রুব ভাবলো, হঠাৎ বৃষ্টি কি বেচারাকে কষ্ট দিচ্ছে নাকি দিন শেষে ক্লান্তির পর আয়েশ ভরা সিগারেটের টানে অসাড় দেহের মাঝে শক্তি যোগাচ্ছে। 

ভাবছে ধ্রুব… ভালো থাকাটা আপেক্ষিক। সারাদিনের এই ব্যস্ততা, এত দৌড়ঝাপ, এত কষ্ট… তাওকি ভালো আছি? ধ্রুব ভাবল বাড়ি যাবার জন্য রিক্সাওয়ালাটাকে ডাকবে কিনা। তার এই আয়েশি সুখটান দেখে ধ্রুবর ইচ্ছে হলো না। ধ্রুব নিজেও সিগারেট খায়। তবে পকেটে অত টাকা নেই। ঘন্টাখানিক আগেই একটা বেনসনের আয়েশি সুখ নিয়েছে। 

একলা। মেডিকেল মোড়। রাত ৯টায় কয়েকজন লোক। সবাই বৃষ্টি থেকে বাঁচতে যেখানে পেরেছে আশ্রয় নিয়েছে। সব কিছু স্থবির। ধ্রুব অপেক্ষা করছে এই বৃষ্টিতে যদি কোন রিক্সা অথবা অটোরিক্সা আসে।

কিছুক্ষণ পর একটি খালি অটোরিক্সা আসলো। গতি দেখেই বুঝা যাচ্ছ বাড়িতে যেতেই হবে তার তবে যাত্রী পেলে ভালো হয়। রংপুর শহরের সিও বাজার যাবে বলে হাক দিচ্ছে। ধ্রুব ডাক দিল, “মামা সিও বাজার থেকে একটু আগায়া দিও।” আমতা আমতা করে রাজি হল অটোওয়ালা। সম্ভবত তার বাড়ি বা গ্যারেজ আরো আগেই। ভাবতে ভাবতে এক দৌড়ে উঠে পড়ল ধ্রুব। রেকসিনের ফাকে মাঝ বয়সী অটো মামাকে একবার দেখেই ধ্রুবর তাকে মাপার চেষ্টা। সারাদিনের ক্লান্তি তাকেও বিষন্ন করে তুলেছে, যেতেই হবে বাড়ি। 

৩০-৪০ সেকেন্ড পরেই মেডিকেল মোড়ের এক নামকরা হোটেলে খাবার খেয়ে এক পরিবার বের হয়েছে। বাবা, সাত-আট বছরের এক ছেলে, মা এবং তার কোলে দুই থেকে আড়াই বছরের একটা মেয়ে। অনেকটা যেন পারফেক্ট মধ্যবিত্ত পরিবার। আমার ওঠা অটোটাকেই তারা ডাকলো। তারাও সম্ভবত সিও বাজার যাবে। অটো মামা ভাড়া নিয়ে যুক্তি উত্থাপনের চেষ্টার মাঝেই তারা হন্তদন্ত হয়ে উঠে পড়ল। মা বাচ্চার মাথা মুছে দিচ্ছে। আমি ভাবলাম নেমে অটোর সামনের সিটে গিয়ে বসি, কিন্তু অটোওয়ালা মানা করল। তার কড়া হিসেব। পিছনে ছয় জন বসতেই হবে। সাথে অটো মামার আশা… যদি সামনে আরো কিছু প্যাসেঞ্জার পায়। যেই ঝুম বৃষ্টি, পাবে কিনা কেউ জানেনা। তবে হঠাৎ চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় তার প্রত্যাশাও শত গুনে বেড়ে গিয়েছে হয়ত। সেই সাথে বেড়েছে তার হাঁক ডাক…. সিও বাজার… এই… সিও বাজার…। কমেছে অটোর গতি। তবু ধীরে ধীরে এগিয়ে চলছে সময়। এগিয়ে চলছে ধ্রুবর ভাবনা। 

আজ কি জানি কি হয়ে গেল। ছোটখাটো ইস্যুতেই এখন দ্রুত রেগে যায় ধ্রুব। শুধু শুধু বিকালের হাতাহাতির ঘটনা। অটো এগুচ্ছে। এগুচ্ছে ধ্রুবর ভাবনা। এগুতে এগুতে আরেকটু সামনে গেল অটো। একজন লোক উঠল সামনে ড্রাইভারের পাশের সিটে। সাথে সাথে ধ্রুব নাকে সিগারেটের তীব্র গন্ধ পেল। ধ্রুবর ভাবনার জাল ছিড়ে গেল। সাদা ফুলশার্ট আর অন্ধকারে কালো মনে হওয়া ফুল প্যান্ট পরা বাবা লোকটা অটোওয়ালা এবং নতুন যাত্রীকে উদ্দেশ্য করে বলল, “ভাই সিগারেটটা ফেলে দেন; বাচ্চা কাচ্চা আছে।” লোকটা ফেলতে চাইল না। ভদ্রলোক বিড় বিড় করে বিরক্ত প্রকাশ করলো। বলল টাকা আছে আপনারা খান, আমাদের টাকাও নাই সিগারেটও খাই না। ধ্রুব হাসলো মনে মনে। উদ্ভট যুক্তি। যাই হোক তাও লোকটা ফিরলো না। 

মিনিটখানেক পর বাবা নামক যন্ত্রিক জীবনের ক্লেষ্ট লোকটা ছোট্ট দুই সন্তানের কথা চিন্তা করে আবার বলল, “ভাই বাচ্চারা আছে ফেলে দিন সিগারেটটা”। যদিও আমার তেমন একটা সমস্যা হচ্ছিল না, তবু আমিও বললাম, “ভাই ফেলে দেন। ফ্যামিলির আছে।” তাও লোকটা ফেললো না। পরিবারের চিন্তায় হোক আর বারবার বলার পর অসম্মানিত বোধ করায় হোক, বাবা লোকটা রেগে গেলেন। বলেল, নবাবের বাচ্চা আসছে। কে শুনে কার কথা। লোকটা সিগারেট ফেলে দিল। নাকি সিগেরেট শেষ হলো বুঝা গেলো না। এর মাঝেই সিও বাজার চলে এসেছে অটো। পরিবারটিও ধ্রুবর মত আরো সামনে যাবে। সামনের লোকটি নেমে গেলো; ভাড়া দিল। ভাড়া দিয়ে পিছনে অটোর রেকসিন তুলে ওই ভদ্রলোকের কলার চেপে ধরল। বলল, “আমি ব্যাটা নবাব, আমি নবাবের বাচ্চা। শালা তুই কে? তোরে নামাইয়া লাশ বানামু”। হঠাৎ ও দ্রুত ঘটে যাওয়া ঘটনায় ধ্রুব অবাক। প্রতিবাদ করার আগেই ভদ্রলোকের শার্টের একটা বুতাম ছিড়ে গিয়েছে। ঝুম বৃষ্টি সেই লোক আঁধারের মাঝে যেন হারিয়ে গেল। কিছু বলারই সুযোগ হলো না। 

ধ্রুব কিছু করতে পারল না এটা নিয়ে সে ভাবছে না। সে ভাবছে তীব্র মোরালিটি নিয়ে যেই বাবা তার  সাত বা আট বছরের ছেলের সামনে অপমানিত হলো, তার স্ত্রীর সামনে অপমানিত হলেঅ, তাদের মাথায় কি ঘুরছে?  ছোট্ট ছেলেটা কি ভাবছে? এই সমাজে অন্যায়ের প্রতিবাদ করাটাই অন্যায়। যেই বাবা রোজ রোজ প্রতিবাদের বুলি শিখায়, সততার পথ দেখায়, এগুলোর ফলাফলই হয়তো অপমান।

ধ্রুব ভাবছে সেই বাবার কথাও। যিনি তার পরিবারের সামনে উঁচু একটা জায়গা থেকে ধুপ করে মাটিতে মিশে গেলেন। কি শিখবে তার পরিবার, কি শিখবে তার সন্তানরা? প্রচণ্ড অপমানে তার ছল ছল চোখ ধ্রুব দেখেছে। তার দুগাল গড়িয়ে পড়া পানির ফোটা বৃষ্টির পানিতে হয়তো ধুয়ে যাবে। কিন্তু সমাজের এই অবক্ষয়, এই দম্ভ, কখনোই ভালো কিছু আনবে না। আজ ৭-৮ বছরের একটা ছেলে যা শিখলো,  এটিই হয়তো তার জীবনে প্রচন্ড খারাপ কিছু হবার প্রথম দীক্ষা।

ধ্রুবর বিরামহীন ভাবনা… ১৫ মিনিটের যাত্রা পথে যুগান্তরের অবক্ষয়।

——————
হাসান ইবনে আমিন
———————

Leave a Comment