এক টুকরো সিগারেট। গন্ধে বো বো করছে দোকানটা।
“ভাই আরেক কাপ চা খাবেন?” হাবিবের হাক।
দে দেখি। দিনের হিসেব মিলাচ্ছে মুদি দোকানদার সামাদ সাহেব। বেশ বড় দোকান। শুকতলা বাজারে তিনটা বড় মুদির দোকানই তাদের দুই ভাইএর। আজ খুব ভাল ব্যবসা হয়নি। যা কয় টাকা বেচা বিক্রি, অর্ধেকই প্রায় বাকী। সৎ বলে সুনাম আছে তাদের দোকানগুলোর। বয়স চল্লিশ ছুয়েছে সামাদের।
সামাদ সাহেবের বাসায় ১৩ বছরের একটা মেয়ে আছে। একটু শ্যামলা। তবে পড়াশোনায় বেশ ভাল। ক্লাস ফাইভে এ প্লাস পেয়েছে মফস্বলের ছোট্ট স্কুল থেকে। সামাদের বড় আশা। মেয়েটাকে হাই স্কুলের মাস্টার বানাবে।
সমাদ ১০ম শ্রেনী উৎরাতে পারেনি। ১৯ বছর বয়সে সৌদীতে যায়। দালালের চাল বুঝতে পারেনি। অবৈধ ভিসা হওয়ায় ২ বছর বের হতে পারেনি রাস্তায়। রিয়াদের এক ঘরে দুই বছর টানা লুকিয়েছিল সামাদ। মাঝে মাঝে তীব্র রোদে বা হাড় কাপানো রাতের বাতাসে বের হত ঘর থেকে। আহ… কত কষ্টের সেই সময়। ঠান্ডা হয়ে আসা চা এ চুমুক দিতে দিতে ভাবছে সামাদ।
আলী ভাইয়ের কারণে আজো বেচে আছে। কয়েকজন বাঙ্গালী থেকে টুকটাক সহযোগিতা নিয়ে তাকে খায়িছেন আলী ভাই। রেখেছেন নিজের ভাইয়ের মত করে সেই সময়ে। আলী ভাইকে কেন জানি খুব মনে পড়ছে আজ সামাদের। খুব হাসি খুসি টগবগে যুবক ছিলেন। বাড়িতে বৌ ছিল নাকি পরীর থেকেও সুন্দরী। মোবাইলের যুগ তখন ছিলনা। তিন মাসের জন্য বাড়ি গেলো লোকটা। ইতিমধ্যে সামাদের ভিসা ও কাজ করার পারমিট রেডি করা হয়েছে। মালীর কাজ। বেস ভালই ছিল। একটু দূরের কোম্পানী। রিয়াদ থেকে কয়েকশ মাইল দূর জেদ্দাতে। আলী ভাইকে ছেড়ে যেতে হবে ভাবলেই সামাদ ভয় পেত।
বাড়ির ছুটি কাটিয়ে আলী ভাই এল। পুরো পাল্টে যাওয়া যেন লোকটা। মাঝে মাঝেই রাত জেগে কাঁদত। বাড়ি গিয়ে নাকি লোকমুখে শুনেছিল বৌ নাকি একবার এবর্শন করিয়েছে। সত্য মিথ্যা জানতনা লোকটা। বৌকে কিছু বলেনি। হাসি মুখে বিদায় নিয়ে এসেছে।
দিন পনের পর জেদ্দা চলে গেল সামাদ। আলী ভাই হাসি মুখে বিদায় দিয়েছিল। টুকটাক জিনিস আর ১০০ রিয়েল দিয়েছিল সেদিন। বলেছিল পরে আবার টাকা পাঠাবে। ভালই চলছিল সামাদের। মাস তিনেক পর খবর পেল আলী ভাই আত্মহত্যা করেছে। শেষের দিকে আলী ভাই নাকি পাগলের মত হয়ে গিয়েছিল।
খুব কেঁদেছিল সামাদ সেদিন। আব্বা আম্মার সাথে যোগাযোগের মাধ্যম ছিল চিঠি। সামাদের এখন স্বাধীন ঠিকানা। সৌদীতে মোট সাত বছর থেকেছে সামাদ। বাপের ৬ লাখ টাকা লোন শোধ করেছে। এই ৭ বছরে সংসারের অধিকাংশ খরচও চালিয়েছে সামাদ। তাও দীর্ঘ এই সময়ে লাখ দুয়েক টাকা আলাদা করে জমিয়েছিল। তার ধ্যান জ্ঞানে সবসময় ঘুরত; আর স্বপ্নের আরব না। এত কষ্ট এখানে… অমানুষিক পরিশ্রম করে দিন শেষে পরিবারকে কাছে না পাওয়ার যে কি কান্না যারা থাকে তারাই জানে।
একবার ফিরে এসে আর যায়নি সে। অনেকে অনেক কথা বলেছে। তাও যায়নি। স্বপ্ন একটাই। পরিবারেরর সাথে থাকা। আলী ভাইয়ের মত যেন না হয় জীবনে। আলী ভাই বলেছিল, “আমিতো ৪ বছর দেশত যাইনা। বৌ’ত ভুল করবই। আমিওত তারে সময় দিতাছিনা। আর গেরামে তার পিছনে লাগনের মত ফালতু লোকের অভাব নাই।” বলেই সে কি কান্না। “দোষ আমারই সামাইদ্দারে…।”
আনমনে অনেক কথা ভাবছে সামাদ। চা’ টাও ঠিকমত খাওয়া হলনা। এশার আজান শুনা যায়। দোকান বন্ধ করতে হবে। আলী ভাই এর কথা মনে হওয়ায় কেন জানি মনটা তার কাঁদছে। হাবিবের দিকে চা এর গ্লাস আর টাকা বাড়িয়ে প্রস্থান করল সামাদ।
দোকান বন্ধ করে, প্রায় দেড় কিলোমিটার হেটেঁ পান চিবুতে চিবুতে বাসায় ঢুকল সামাদ। ‘আমার আম্মা কইরে!’ বলতে বলতে।
দৌরে মেয়েটা বাপের বুকে আছড়ে পড়লা। সামাদের চোখে কোণে জল। সাদিয়ার মা মারা গেছে সাদিয়ার ছোট ভাইয়ের জন্মের সময়। বাচ্চাটাও টিকেছে ৪দিন। সাদিয়ার বয়স তখন সাড়ে তিন। রোজ ঘরে ফিরে সামাদ। তবে যে স্বপ্ন নিয়ে বিদেশ ছেড়েছে তা পূর্ণ হয়নি। আলী ভাইয়ের মতই কেন যেন একা। শুধু মেয়ে সাদিয়ার জন্য বেঁচে থাকা।
সামাদের বৌটাও পরী ছিল। কালো পরী। ১৭ বছর বয়স ছিল যখন সাদিয়ার মা সামাদের ঘরে আসে। শ্যামলা মেয়েটা কি যে জাদু জানত। সাদিয়ার মা এসএসসি পাশ করেছিল। খুব খোটা দিত সামাদকে ‘মেট্রিক ফেল’ বলে। কত রাত নাঘুমিয়ে ফিসফিস করে কাটিয়েছে…
চোখের কোনের জল লুকিয়ে সাদিয়াকে সরিয়ে ঘরে ঢুকল সামাদ। মেয়েকে বলল, “দাদীর কাছে যা মা।”
আজ খুব চিৎকার করে কাঁদতে মন চাচ্ছে। গোসল খানায় গেল সামাদ…… মটর দিয়ে সদ্য তোলা ঠান্ডা পনি আর চোখের জলের কোনো পার্থক্য যেন নেই। এই বহমান জীবনে কোনো মূল্যই নেই ডুকরে ওঠা সামাদের এই কান্নার…
হাসান ইবনে আমিন (১৬ মার্চ ২০১৭)